প্রথমেই দুটি দৃশ্যের কথা ভাবুন। পাঁচ বছরের একটি শিশুকে ভুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক নরপিশাচ। তার উপর বীভৎসভাবে যৌননির্যাতন চালাচ্ছে। তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করছে। ঘটনাটি ঘটছে আমাজনের অরণ্যে কোনো নরখাদকের আস্তানায় নয়, বাংলাদেশের পার্বতীপুরে।
বড় রাস্তার ওপর দিনে দুপুরে দুটি মেয়েকে এলোপাতাড়ি পিটাচ্ছে এক বখাটে। মেয়ে দুটি সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে। চারপাশের মানুষ ভিড় করে মোবাইলে তাদের ছবি তুলছে। কিন্তু কেউ মেয়েদুটির সাহায্যে এগিয়ে যাচ্ছে না। এই ঘটনাটিও সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে নয় ঘটছে বাংলাদেশে। মিরপুরে কলেজছাত্রী দুই জমজ বোনের ওপর বখাটের হামলার পর এমন ঘটনাই ঘটে। এমনকি এক পর্যায়ে মেয়েদুটিকে বাঁশ হাতে তাড়া করে সেটা দিয়ে আঘাত করে একজনের পা ভেঙে দেয় জীবন নামের সেই নরপিশাচ বখাটে। তারপরও কিন্তু আশপাশের মানুষ এগিয়ে আসেনি। কয়েকদিন আগে জীবনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মনে পড়ছে সিলেটে শিশু রাজন হত্যার ঘটনা। রাজনকে যখন পিটিয়ে মারা হচ্ছে তখনও অনেক মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল। কিন্তু এই লোকদের কেউ এগিয়ে যায়নি অসহায় শিশুটিকে বাঁচাতে।
বাগের হাটে গৃহবধূকে ১৫ দিন ধরে ঘরে আটকে এবং তার পরিবারের লোকদের জিম্মি করে ধর্ষণ চালায় সোবাহান মোল্লা নামে আরেক নরপিশাচ। সেই নারীর পা ধারালো অস্ত্রের কোপে কেটেও ফেলে সে। ধর্ষণের শিকার নারীর আর্তনাদ শোনা যায় পনের দিন ধরে তবু গ্রামের মানুষ এগিয়ে আসেনি পরিবারটিকে বাঁচাতে।
রাজধানীর দক্ষিণখানে ঘরের ভিতর দরজা ভেঙে ঢুকে পরিবারের সকলের উপস্থিতিতে এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সিলেটে কলেজ ছাত্রী খাদিজাকে যখন সন্ত্রাসী বদরুল চাপাতি দিয়ে আঘাত করতে থাকে সেসময় অনেক মানুষ মোবাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকলেও তাকে বাঁচাতে এগিয়ে যায়নি। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। সমাজের মানুষের এ ধরনের উদাসীনতা এবং অন্যায়ের প্রতিকারে এগিয়ে যাবার অনীহা মানুষের স্বাভাবিক আচরণ নয়।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজবদ্ধ হিসেবেই তার শক্তি। একজন একক মানুষ কিন্তু খুবই দুর্বল। সমাজের সম্মিলিত নৈতিক চাপ, সমাজের মূল্যবোধ, সামাজিক একতা পুরো সমাজকে রক্ষা করে, নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু সামাজের এই মূল্যবোধ যখন ধ্বংসের মুখোমুখি হয়, যখন সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যায়, যখন সমাজের মানুষ চোখের সামনে অন্যায় সংঘটিত হতে দেখেও এগিয়ে যায় না তখন বুঝতে হবে গোটা সমাজই ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পথে চলছে।
পার্বতীপুরে পাঁচ বছরের শিশুর ধর্ষক হিসেবে ধরা পড়েছে সাইফুল নামে চল্লিশোর্ধ্ব এক লম্পট মাদকাসক্ত ব্যক্তি। এই ব্যক্তি এতদিন সমাজে কিভাবে মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল? কেন এর আগেই তাকে আইনের আওতায় আনা হয়নি মাদকসেবনের অপরাধে?একটি সমাজের মূল্যবোধ কোন পর্যায়ে পৌঁছালে পাঁচ বছরের শিশু এইভাবে ধর্ষণের শিকার হয়!
অতীতে গ্রামের বা শহরের কোনো বাড়িতে ডাকাত হামলা করলে আশপাশের মানুষ এগিয়ে আসতো তা প্রতিরোধে। এখন ভয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে। কেন এই প্রবণতা? কথায় আছে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। অন্যায় প্রতিরোধ করতে গিয়ে পাছে পুলিশী ঝামেলায় ফেঁসে যেতে হয় সেই ভয়েই কি মানুষ চোখের সামনে অপরাধ হতে দেখলেও নিষ্ক্রিয় থাকে?
প্রভাবশালী ধর্ষক ও বখাটেরা অনেক সময় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়ের ছত্রছায়ায় থাকে। জনতার হাতে কখনও কখনও তারা ধরা পড়লেও পরে ঠিকই আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে আসে। বেরিয়ে এসে তারা প্রতিশোধ নিতে হামলা চালায় তাদের ওপরে যারা তাকে বা তাদের ধরিয়ে দিয়েছে। এই সব ভয়ে মানুষ প্রকাশ্যে অপরাধ হতে দেখলেও তা প্রতিরোধে এগিয়ে যায় না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একসময় নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হতো। এখন আদর্শলিপি, নীতিশিক্ষার দিন অতীত হয়েছে। আজকাল স্কুলের শিশুশ্রেণিতে আর আদর্শলিপি এবং সে ধরনের বই পড়ানো হয় না। শিক্ষকরা কোচিংয়ের ধান্ধায় শ্রেণিকক্ষে ঠিকমতো পড়াতেই পারে না, শিক্ষার্থীদের নীতিশিক্ষা দেয়া তো অনেক দূরের কথা। নীতিনৈতিকতাহীন পশুশ্রেণির মানুষের সংখ্যা তাই বাড়ছে দিনের পর দিন। ক্ষমতা বিস্তারের জন্য সমাজপতিদের কাছে নিরীহ ভালোমানুষের চেয়ে গুণ্ডা মাস্তানদেরই কদর বেশি। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও রাজনৈতিক প্রভাবশালী, তাদের জ্ঞাতিগুষ্ঠি এবং মাস্তান বখাটে ও তাদের সন্তানদের কদর অনেক বেশি হয়। একটি শিশু যখন ছোটবেলাতেই দেখে ‘ভালো’ হওয়ার চেয়ে ‘মন্দ’ হলেই সুবিধা বেশি, ভালো মানুষ হওয়ার কোনো দাম নেই। তখন স্বাভাবিকভাবেই তার নীতি নৈতিকতা ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচকের পথেই প্রবাহিত হয়। সে ভ্রান্ত চিন্তা, ভ্রান্ত মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এভাবেই নীতিহীনতার জয় ঘোষিত হতে থাকে। ইতিবাচক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ জাগতিকভাবে পরাজয়ের স্বীকার হয়, হামলার শিকার হয়, অপমানের শিকার হয়। মানুষের বিপদে মানুষ আর এগিয়ে যাবার উৎসাহ পায় না। ভয়ে শংকায় নিজের ভিতরে গুটিয়ে থাকে।
আর মানুষের বিপদে এগিয়ে না গিয়ে যারা মোবাইলে দৃশ্য ধারণ করতে ব্যস্ত থাকে তাদের মনুষ্যত্ব সম্পর্কেই সন্দেহ সৃষ্টি হয়। সমাজের সর্বস্তরে নৈতিক অধঃপতনই যে এর কারণ তা বলাই বাহুল্য।
নৈতিক পতন থেকে সমাজকে, সমাজের অধিকাংশ মানুষকে উদ্ধারের জন্য দরকার সাংস্কৃতিক আন্দোলন। শৈশব থেকে নৈতিক শিক্ষা এবং জীবনে এর প্রতিফলন প্রয়োজন। আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা দরকার সর্বত্র। অপরাধীরা যদি কঠোর শাস্তি পায়, মানুষের বিপদে যারা এগিয়ে আসে তারা যদি পুরস্কৃত হয়, শুভর জয় আর অশুভর পরাজয় ঘটে একমাত্র তখনই সম্ভব হবে নৈতিক মূল্যবোধগুলোর ফিরে আসা।
আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। নইলে আমাদের নীতিবোধকে কবর দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। আর যে সমাজে শুভবোধ মৃত্যুবরণ করে সেই সমাজের পটল তুলতেও যে বিলম্ব হয় না সে কথা বলাই বাহুল্য।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
পাঠকের মতামত